রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৪৫ অপরাহ্ন
এম আই ফারুক আহমেদ, কালের খবর :
শিক্ষার্থী ভর্তিতে দুর্নীতির দায়ে শাস্তি একাধিকবার পেয়েছেন। এরপরেও নিজেকে শোধরাতে পারেননি মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম। তার বিরুদ্ধে নতুন করে ওঠা দুর্নীতির একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বুধবার থেকে ঢাকা অঞ্চলের শিক্ষা অফিসের পরিচালক ড. মো. ইউছুফের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি তদন্ত দল ইংলিশ ভার্সনের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির দুর্নীতির বিষয়টি তদন্ত শুরু করে। গতকাল মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে গিয়ে সারাদিন বিভিন্ন নথি খতিয়ে দেখেছে তদন্ত কমিটি। এ বছর প্রতিষ্ঠানটিতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে যারা ভর্তি হয়েছে তাদের সবার উত্তরপত্র নিয়ে এসেছে তদন্ত কমিটি।
ঢাকার শীর্ষ স্কুলগুলোর মধ্যে আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ ওপরের দিকে। সেরা এ স্কুলটিতে প্রতি বছরই ভর্তিতে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। তবে এবার আরো গুরুতর অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে সরকারের তদন্ত কমিটি। চলতি বছর দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তিতে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ফেব্রুয়ারিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন এক অভিভাবক।
এর আগে ২০০৭ সালে ৫১৮ জন শিক্ষার্থীকে অবৈধভাবে ভর্তি করানোর দায়ে বরখাস্ত, ২০১২ সালে ভর্তিতে বেশি টাকা নিয়ে ‘ধরা’ খেয়েছিলেন এবং এমপিও স্থগিত করা হয়েছিল এই অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমের। অথচ ‘নিজের কারিসমা’ দেখিয়ে বরখাস্ত এবং এমপিও স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করাসহ স্বপদে বহাল থেকে ভর্তির দুর্নীতি অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন পিএইচডি ডিগ্রিধারী এই অধ্যক্ষ। সর্বশেষ ২০১৮ সালের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণিতে প্রতিষ্ঠানটির বাংলা ও ইংলিশ ভার্সনে জনপ্রতি তিন লাখ টাকা করে নিয়ে মোট একশজনকে ভর্তি করার অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছেন শাহান আরা বেগম। এর মধ্যে বাংলা ভার্সনে ভর্তির দুর্নীতি প্রমাণিত হয়েছে। ইংলিশ ভার্সনের দুর্নীতির সত্যতা জানতে তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে উত্তরপত্রে ঘষামাজা নিয়ে তদন্তের সময় তদন্ত কর্মকর্তাকে দেয়া লিখিত জবাবে যেসব শিক্ষক খাতা মূল্যায়ন করেছেন তাদের দায়ী করেছেন অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম।
লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম সহকারী প্রধান শিক্ষক আব্দুস ছালাম খান এবং কয়েকজন সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের মতিঝিল, বনশ্রী এবং মুগদা শাখায় চলতি বছরের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্রে ঘষামাজা করে ভুল উত্তর রাবার দিয়ে মুছে সেই স্থানে শুদ্ধ উত্তর লিখে নম্বর দিয়ে ফেল করা ছাত্রছাত্রীকে পাস করিয়ে দিয়েছেন। অধ্যক্ষ শাহান আরা তার দলবল নিয়ে মাথাপিছু তিন লাখ টাকা ‘ঘুষ’ নিয়ে একশজন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করিয়ে মোট তিন কোটি টাকা আয় করেছেন।
এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ঢাকা জেলা প্রশাসন তদন্তে নামে। তদন্তে ১২২টি উত্তরপত্র পর্যালোচনা করে কমিটি প্রতিবেদনে সার্বিক মতামত দিয়ে জানায়, সার্বিক পর্যালোচনায় অভিযোগকারীর বক্তব্য, তার দাখিলকৃত জবাব ও রেকর্ডপত্র পরীক্ষা করে পরীক্ষার খাতায় ঘষামাজা সংক্রান্ত অভিযোগকারী শ্যামলী সিমুর আনীত অভিযোগের বিষয়ে সত্যতা রয়েছে। তবে অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম, প্রকৌশলী আতিকুর রহমান, হিসাব সহকারী দীপা, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী কবির হোসেন ও আতিকুর রহমান নিজ হাতে উত্তরপত্রে উত্তর লিখে দেয়ার বিষয়টির সত্যতা স্পষ্টীকরণ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু অভিযোগকারী উত্তরপত্রে ঘষামাজা করার জন্য তাদের অভিযুক্ত করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ভর্তিতে দুর্নীতি হয়েছে, উত্তরপত্রে ঘষামাজা হয়েছে কিন্তু এগুলো কে করেছে তার উত্তর বের হয়নি। এদিকে, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের নজিরবিহীন ভর্তি কেলেঙ্কারি প্রমাণিত হওয়ার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ থেকে গত মঙ্গলবার মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালককে চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের মতিঝিল, মুগদা ও বনশ্রী শাখায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষার খাতায় ঘষামাজা সংক্রান্ত আনীত অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদনের সত্যতা পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় অভিযোগের বিষয়ে অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমের সুষ্পষ্ট ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে হবে। এই ব্যাখ্যার আলোকে আগামী সাত দিনের মধ্যে মতামত দিতে মাউশি মহাপরিচালককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান গত মঙ্গলবার কালের খবরকে বলেন, মাত্র একটি তদন্ত প্রতিবেদন আমাদের হাতে এসেছে। ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিস আরেকটি তদন্ত করছে, সেটি আসার পরই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের নেয়া ব্যবস্থার ধরন প্রকাশ পাবে।
প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম এ ব্যাপারে কালের খবরকে বলেন, এই দুর্নীতিতে তিনি জড়িত নন। আর এসব কথা লিখিতভাবে তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছেন। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছে শাহান আরা তদন্ত কমিটিতে যে লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন সেটি বাংলায় লেখা হলেও অধ্যক্ষ ইংরেজিতে সই দিয়েছেন। এতে অনেকেই প্রশ্ন তুলে বলেছেন, লিখিত জবাবটি শাহান আরা নিজে লেখেননি। অন্য কেউ লিখে দিয়েছেন, শাহান আরা শুধু সই করেছেন। তবে অসুস্থ থাকায় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি সরকারের যুগ্ম সচিব আবু হেনা মোর্শেদ জামানের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবীর দুলু কালের খবরকে বলেন, উত্তরপত্রে কার লেখা, কার ঘষামাজা এটা বের করতে হলে সিআইডির হস্তরেখা বিশারদ দিয়ে তদন্ত করা উচিত। তবেই মূল অভিযুক্তকে ধরা সম্ভব।
৬৯টি উত্তরপত্র জব্দ : ঢাকা জেলা প্রশাসনের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর ও তদন্তকারী কর্মকর্তা তাসলিমা মোস্তারী গত ১০ জুলাই মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল সরেজমিন তদন্ত করেন। তারা প্রতিষ্ঠানের মতিঝিল, মুগদা ও বনশ্রী শাখার ভর্তি হওয়া দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণির ১২২ জনের ভর্তি পরীক্ষার উত্তরপত্র পর্যালোচনা করেন। এতে ৬৯টি খাতা জব্দ করা হয়।
খাতাগুলো বর্তমানে গুলশান থানার শিক্ষা অফিসারের তত্ত¡বধানে রাখা হয়েছে। এসব খাতায় উত্তর রাবার দিয়ে মুছে ঘষামাজা ও ওভারাইটিং করা হয়েছে। কিছু খাতায় হাতের লেখার অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। খাতায় ঘষামাজা করার প্রমাণ পাওয়া গেলেও অভিযুক্তরা তা করেছেন বলে স্বীকার করেননি। তবে খাতার ঘষামাজার সঙ্গে অভিযুক্ত অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম, সহকারী প্রধান শিক্ষক আ. ছালাম খান, হিসাব সহকারী দীপা, প্রকৌশলী আতিকুর রহমান এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী কবির হোসেন ও আতিকুর রহমান লেখার সঙ্গে সম্পৃক্ত কিনা অনুসন্ধানে তা স্পষ্ট করা হয়নি।
উল্লেখ্য, গত ফেব্রুয়ারিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে লিখিত অভিযোগ করে অভিভাবক শ্যামলী সিমু বলেছেন, ২০১৮ সালের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষায় উত্তরপত্রে ঘষামাজা ও ভুল উত্তর রাবার দিয়ে মুছে সেই স্থানে শুদ্ধ উত্তর লিখে নম্বর দিয়ে ফেল করা ছাত্রছাত্রীদের পাস করিয়ে দিয়েছেন মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম।
আর এ কাজে অধ্যক্ষকে সহযোগিতা করেছেন সহকারী প্রধান শিক্ষক আ. ছালাম খান, হিসাব সহকারী দীপা, প্রকৌশলী আতিকুর রহমান এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী কবির হোসেন ও আতিকুর রহমান।